তথ্য ও প্রযুক্তির মশাল জ্বলে উঠুক হাতে হাতে

গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ কেন হয় এবং করণীয় কি





গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ বা যোনীপথে স্পটিং হওয়া স্বাভাবিক বিশেষ করে গর্ভাবস্থার শুরুর দিকে। প্রতি ৪ জন মায়ের ১ জনের প্রথম দিকে হালকা রক্তপাত হয়। এটি কোন সমস্যার কারণ নয় ৷ কিন্তু যেহেতু রক্তপাত হওয়া অন্য আরও জটিলতার লক্ষন ৷ তাই এটি দেখা গেলেই দেরী না করে ডাক্তারকে জানানো উচিত যাতে তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে সবকিছু ঠিক আছে কিনা?

গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ অনেক সময় কোন মারাত্মক জটিলতারও লক্ষন হতে পারে, যেমন-একটোপিক প্রেগন্যান্সি, গর্ভপাত বা প্লাসেন্টা জনিত কোন সমস্যা ইত্যাদি। ডাক্তার রক্তপাতের কারণ জানার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করতে পারেন, যেমন-শারীরিক পরীক্ষা, আলট্রাসাউন্ড, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি যাতে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন যে গর্ভবতী মা এবং গর্ভের শিশুর সবকিছু ঠিকঠাক আছে।


গর্ভাবস্থায় কি কি কারণে রক্তক্ষরণ বা স্পটিং হতে পারে?

ইমপ্ল্যান্টেশনঃ কিছু কিছু মহিলা তার গর্ভবতী কিনা তা জানার আগেই হাল্কা স্পটিং লক্ষ করে থাকেন। অনেকে এটাকে মাসিক মনে করতে পারেন। এটা ওভুলেশনের এক থেকে দু সপ্তাহের মধ্যে হতে পারে। এটাকে ইমপ্ল্যান্টেশন ব্লীডিং বলে ৷ কারণ জরায়ুতে ভ্রুন স্থাপিত বা ইমপ্লেনটেশন এর সময় এ রক্তপাত হতে পারে যে প্রক্রিয়াটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার ৬ দিনের মধ্যেই শুরু হয়। যদি পিরিয়ড শুরু হওয়ার সপ্তাহ খানেক আগে একদিন বা দুদিন এ ধরনের স্পটিং দেখা যায় তবে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে দেখতে পারেন। যদি রেজাল্ট নেগেটিভ আসে তবে কিছুদিন অপেক্ষা করুন। যদি যথা সময়ে পিরিয়ড শুরু না হয় তবে আবার টেস্ট করুন।

এবর্শনঃ প্রথম ট্রাইমেস্টারে পেট ব্যাথা এবং খিলধরা ভাবের সাথে রক্তপাত গর্ভপাতের লক্ষন হতে পারে বিশেষ করে প্রথম ১২ সপ্তাহে। প্রায় ৫০ ভাগ মহিলার ক্ষেত্রে যাদের প্রথম ট্রাইমেস্টারে রক্তপাত দেখা যায় তাদের গর্ভপাত হয়ে যায়। তবে যদি ৭-১১ সপ্তাহের আল্ট্রাসাউন্ডে বাচ্চার নরমাল হার্টবিট পাওয়া যায় তবে স্বাভাবিক গর্ভধারণের সম্ভাবনা ৯০% এর বেশী থাকে।

এক্টোপিক প্রেগন্যান্সিঃ গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির লক্ষনও হতে পারে যখন ভ্রুন জরায়ুর বাইরে প্রতিস্থাপিত হয় বিশেষ করে ফেলোপিয়ান টিউবে। এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির অন্যান্য লক্ষন গুলো হলো পেটে, পেলভিকে বা ঘারে ব্যাথা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব উপসর্গ নাও দেখা যেতে পারে। এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই প্রথম ট্রাইমেস্টারে রক্তপাত বা ব্যাথা হলে দেরী না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

মোলার প্রেগন্যান্সিঃ মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে ভ্রুন গঠিত হওয়ার পরিবর্তে অস্বাভাবিক সিস্ট বা টিউমারে পরিণত হয় যা দেখতে আঙ্গুরের থোকার মত হয়। মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে প্রথম দিকে স্বাভাবিক গর্ভধারণের লক্ষনগুলো দেখা যায় কিন্তু কিছুদিন পরেই রক্ত ক্ষরণ সহ আরও কিছু জটিলতা দেখা দেয়। মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে রক্তপাত ছাড়াও বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, পেটে খিল ধরা বা পেট অস্বাভাবিক ভাবে বড় হয়ে যেতে পারে। কারন মোলার প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে জরায়ু স্বাভাবিকের চাইতে দ্রুত বাড়ে।

ইনফেকশনঃ যৌনাঙ্গে ইনফেকশনের কারনেও রক্তপাত হতে পারে। ভ্যাজিনাল ইনফেকশন যেমন- ইস্ট ইনফেকশন, ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস ইত্যাদির কারণে বা যৌন বাহিত রোগ, যেমন- ট্রাইকোমোনাসিস, গনোরিয়া, ক্লামিডিয়া বা হারপিস এর কারণে যোনী পথে রক্তক্ষরণ হতে পারে।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে রক্তপাতের কারণঃ
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ট্রামেস্টারে অস্বাভাবিক রক্তপাত মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকি কারণ হতে পারে। তাই এ সময় রক্তক্ষরণ দেখলেই দেরী না করে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করতে হবে।

প্লাসেন্টা প্রিভিয়াঃ প্লাসেন্টা যদি জরায়ুর একদম নিচের দিকে বা জরায়ুমুখে লেগে থাকে, তাহলে এই মেডিকেল কন্ডিশনকে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা লো লায়িং প্লাসেন্টা বলে। প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার সমস্যায় সাধারণত গর্ভবতী নারীরা স্পটিং বা হালকা থেকে ভারী রক্তপাতের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কিন্তু এ রক্তপাতের সময় কোন ব্যথা অনুভূত হয় না এবং রক্তের রং থাকে উজ্জ্বল লাল।

প্লাসেন্টা অ্যাকরিটাঃ প্লাসেন্টা অ্যাকরিটা এমন একটি কন্ডিশন যাতে প্লাসেন্টা জরায়ুর দেয়ালের অনেক গভীরে সংযুক্ত থাকে। প্লাসেন্টা অ্যাকরিটা থাকলে তা প্রসবের সময় সহজে জরায়ু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়না এবং এতে অনেক রক্তক্ষরণ হতে পারে। তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে যোনিপথে রক্তক্ষরণও এর লক্ষন হতে পারে।

প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশনঃ গর্ভকালীন বা সন্তান প্রসবের পূর্বে অনেক সময় প্লাসেন্টা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে জরায়ুর দেয়াল থেকে আলাদা হয়ে যায় বা ছিঁড়ে যেতে পারে। এ ধরনের কন্ডিশনকে প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশন বলে।প্রতি ১০টি অ্যাবরাপশনের ৮ টির ক্ষেত্রেই যোনিপথে রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্তক্ষরণের পরিমাণ অল্পও হতে পারে বা প্রকট আকারেও দেখা দিতে পারে। রক্ত কখনো উজ্জ্বল লাল আবার কখনো গাঢ় বর্ণের হতে পারে। প্লাসেন্টাল অ্যাবরাপশনের অন্যান্য লক্ষন গুলোর মধ্যে আছে- পেটে ব্যাথা হওয়া বা স্পর্শকাতর হয়ে ওঠা, ব্যাকপেইন, জরায়ুতে ঘন ঘন এবং একটানা সংকোচন অনুভব করা ইত্যাদি।

প্রি-টার্ম লেবারঃ যদি কোন কারণে ৩৭ সপ্তাহের আগেই গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত জরায়ু সংকোচন হতে থাকে এবং তার ফলে জরায়ু মুখ খুলে যায় তবে তাকে প্রি-টার্ম লেবার বলে। এর ফলে যোনী পথে রক্তপাত হতে পারে। প্রি-টার্ম লেবারের অন্যান্য লক্ষন গুলো হলো -
যোনিপথে নির্গত স্রাবের পরিমান বেড়ে যাওয়া, তলপেটে ব্যথা, কোমরে ব্যথা ও খিল ধরা অনুভুতি, পেলভিক এরিয়াতে বেশী চাপ অনুভব করা, অনবরত চাপা বা কিছুক্ষন পর পর পিঠে ব্যাথা করা ইত্যাদি।

এছাড়াও গর্ভাবস্থায় জরায়ুর দিকে বেশী পরিমাণে রক্ত প্রবাহিত হয়, তাই মিলনের পর স্পটিং লক্ষ্য করা অস্বাভাবিক কিছু নয় । যৌনমিলন ব্যতীত, জরায়ুর পলিপ ও স্পটিং বা রক্তপাতের কারণ হতে পারে ৷ প্যাপ স্মিয়ার বা অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার কারণে জরায়ুর বা সার্ভিকাল পলিপ থেকে বেশীমাত্রায় রক্ত-প্রবাহের ফলেও স্পটিং হতে পারে ।

গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ দেখা গেলে করণীয়
যেহেতু গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ ঝুঁকির কারণ তাই এমনটা হলে সাথে সাথে ডাক্তারকে জানাতে হবে। কি পরিমানে রক্তপাত হচ্ছে বা তার ধরন জানার জন্য প্যাড ব্যাবহার করতে পারেন। যদি রক্তের সাথে টিস্যু জাতীয় কিছু বেড়িয়ে আসে তবে তা ফেলে না দিয়ে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেন যাতে তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এ সময় Tampon ব্যাবহার করা ও শারীরিক মিলন থেকে বিরত থাকুন। অনেক মহিলা গর্ভাবস্থায় রক্তপাত স্বত্ত্বেও কোনো জটিলতা ছাড়াই সন্তান-প্রসব করতে সফল হন,কিন্তু পরীক্ষা না করা পর্যন্ত এটিকে গুরুতর সমস্যার খাতা থেকে বাদ দেবেন না । রক্ত বেশি গেলে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এ অবস্থায় যে কোনো সময় রোগীর রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। তাই এ সময় রক্তের ডোনার রেডি রাখতে হবে।